বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি তে আওয়ামী দোসরের ভয়ংকর রূপ

Mar 20, 2025 - 00:11
 0
বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি তে আওয়ামী দোসরের ভয়ংকর রূপ

বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির তহবিল বিভাগের পরিচালক ডা. শাহানা জাফর। আওয়ামী শাসনামলে একাধিপত্য কায়েম করে বিপুল পরিমাণ অবৈধ বিত্তের মালিক হয়েছেন তিনি।

 এই অবৈধ উপায়ে বিত্ত-বৈভব গড়ে তোলার ক্ষেত্রে চাকরি জীবনে  কাজ নেই যা ডা. শাহানা জাফর করেননি। টাকার জন্য তিনি হাসপাতাল প্রাঙ্গনকে ‘গরুর হাটে’ পরিণতও করেছেন। গরুপ্রতি টাকা নিয়ে ভাড়া দিয়েছেন শহীদ ময়েজ উদ্দীন রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতাল প্রাঙ্গণকেও।

৫ আগস্টের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের দুঃশাসনের অবসান হলেও প্রশাসনের সকল স্তরে ঘাপটি মেরে আছে আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের দোসর। ডা. শাহানা জাফর একনিষ্ঠ আওয়ামীপ্রেমী ফ্যাসিস্টদের দোসর হলেও এখন তিনি আওয়ামী পরিচয় লুকিয়ে বৈষম্য বিরোধী ‘আলখেল্লা’র আড়ালে আওয়ামী আদর্শেই হাঁটছেন।

২০২৪ সালের ৪ নভেম্বর এক সম্মেলনে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির চেয়ারম্যান ও আইএফআরসি’র গভর্নিং বোর্ডের সদস্য মেজর জেনারেল (অব.) মো. রফিকুল ইসলাম বলেছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের সময় রেড ক্রিসেন্টের অনেকের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যহার ও দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগ উঠেছে। এসব অভিযোগ যাচাই-বাছাইয়ের জন্য বোর্ড গঠন করা হয়েছে। বোর্ড সদস্যরা অভিযোগের সত্যতা পেলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অথচ এখনও আওয়ামী দোসর ডা. শাহানা জাফর বহাল তবিয়তে টিকে আছেন, গোপনে তাদের ও দলের মিশন পরিচালনা করছেন। এ বিষয়ে তার ভূমিকা বিতর্কিত প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে।

ডা. শাহানা জাফর অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিতে এখনও সকল ধরনের অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন- এমন অভিযোগ করেন নাম প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক সোসাইটির প্রধান কার্যালয় ও বিভিন্ন ইউনিটের একাধিক কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ডা. শাহানার মতো কর্মকর্তার অপকর্মের ফলে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির মতো বৃহৎ এই মানবিক প্রতিষ্ঠানের সুনাম আগেও ক্ষুন্ন হয়েছে, এখনও হচ্ছে। ডা. শাহানা জাফরের বিরুদ্ধে দুর্নীতি-অনিয়ম, অনৈতিক সম্পর্কে আবদ্ধ থাকার অভিযোগ উঠলেও তিনি বিশেষ কৌশলে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করে সবসময় রেহাই পেয়েছেন। তার বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ থাকার পরও কেন অ্যাকশন নেয়া হচ্ছে না- এমন প্রশ্ন করে বিস্ময় প্রকাশ করেন তারা।

অভিযোগ সূত্রে জানা যায়,  ডা. শাহানা জাফর সোসাইটির সাবেক উপ-মহাসচিব জাকারিয়া খালেদের সাথে বিশেষ সম্পর্কে থাকার কারণেই বিগত সময়ে নানান অপকর্ম করেও পাড় পেয়ে যান। ক্ষমতাচ্যুত ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসর রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির সাবেক ম্যানেজিং কমিটির ভাইস-চেয়ারম্যান নুর-উর রহমানের সাথে বিশেষ সখ্য থাকার কারণে সোসাইটিতে বিভিন্ন প্রকার অনৈতিক কর্মকান্ড করে অর্থ আত্মসাৎ এবং নিয়োগ-বাণিজ্যে করেছন ডা. শাহানা জাফর।

ডা. শাহানা জাফরের সহযোগিতা নিয়ে বিগত কমিটির ট্রেজারার ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের স্বাস্থ্য উপ-কমিটির সদস্য ব্যবসায়ী এম. এ সালাম রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিতে অনৈতিকভবে অনেক অপকর্ম করেছেন প্রকাশ্যেই। দুর্নীতিবাজ এই চক্রের অনিয়ম-দুর্নীতি ‘ওপেন সিক্রেট’ ছিল বলেই সোসাইটি পরিণত হয় দুর্নীতির আখড়ায়। তাদের অবাধ অনিয়মে অন্যরাও অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন।

পতিত ফ্যাসিস্ট সরকারের সুবিধাভোগী ম্যানেজিং বোর্ড ভেঙ্গে দেয়া হলেও বিএনপি’র কর্মী পরিচয়ে আওয়ামীপ্রেমী ডা. শাহানা জাফর পূর্বের মতোই ক্ষমতাসীন বিভিন্ন জনের সাথে সখ্য গড়ে তুলছেন এবং তাদের নাম ব্যবহার করে সোসাইটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হুমকি ও ভয়ভীতি প্রদর্শন করছেন।

ডা. শাহানা জাফরের দুর্নীতির আমলনামা: গত ২০২১ সালের ২২ জুন স্বাস্থ্য বিভাগের প্রাক্তন পরিচালক ডা. শাহানা জাফরের বিরুদ্ধে দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগ তদন্তে এক সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়। পরিচালক ইকরাম ইলাহী চৌধূরী, ডিআরএম বিভাগ তদন্ত কমিটির আহবায়ক ও সদস্য মনোনীত করা হয়। তদন্তকারী কর্মকর্তাকে সার্বিক সহায়তার জন্য স্বাস্থ্য বিভাগের উপ-পরিচালক, মো: বেলাল হোসেন সরদার এবং এইচ আর বিভাগের উপ-পরিচালক, জয় চাটার্জীকে নির্দেশ প্রদান করা হয়।

ডা. শাহানা জাফরের বিরুদ্ধে আমেনা খাতুন রেড ক্রিসেন্ট মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র, মুরাদনগর, কুমিল্লা’র পরিচালনা কমিটির সাবেক সভাপতি মামুনুর রশিদ লিখিত অভিযোগ করেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি শহীদ ময়েজ উদ্দীন রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতাল, বাংলাবাজার, ঢাকা’র স্থানীয় বাসিন্দাদের পক্ষ থেকে হাসপাতাল প্রাঙ্গনে কোরবানীর গরু রাখা এবং গরু চুরি ।

গত ২০২০ সালের ২৩ ডিসেম্বর প্রজেক্ট ম্যানেজার পদে Health care Project, Cox Bazar  এর নিয়োগ পরীক্ষার সম্মিলিত নম্বর পত্রে নিয়োগ কমিটির সদস্য হিসাবে স্বাক্ষর করতে অস্বীকৃতি এবং কমিটির সদস্যসহ সিনিয়রদের বিরুদ্ধে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট মিথ্যা ও অসত্য তথ্য প্রদান করা।

তদন্ত কমিটি সরজমিনে তদন্ত, প্রয়োজনীয় স্বাক্ষ্যগ্রহণ ও নথি পূর্ববর্তী তদন্ত রিপোর্ট পর্যালোচনা সাপেক্ষে উল্লেখ করেন, মামুন চেয়ারম্যানের কাছে জানা যায়, তিনি অর্থের বিনিময়ে সেখানে ছোট শারমিন নামে একজনকে ট্রেনি মিডওয়াইফ মৌখিকভাবে Deployment দিয়ে রেখেছেন যার বেতন ডা. শাহানা জাফরের নির্দেশনা মোতাবেক পরীবানু কেন্দ্রের আয় হতে নগদে পরিশোধ করে থাকেন।

তার মেয়াদের শেষের দিকে হাসপাতালের জমি দখলকারীর সাথে মৌখিক সমঝোতার মাধ্যমে ডা: শাহানা জাফর মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে দখলদারকে হাসপাতালের কিছু জমি দিয়ে দেয়ার মৌখিক চুক্তি করেছিলেন।

পরবর্তীতে তদন্তের স্বার্থে চাপিতলা আমেনা খাতুন রেড ক্রিসেন্ট মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে সরজমিনে তদন্ত কর্মকর্তা ও সহযোগীগণ গিয়ে তৎকালিন এবং বর্তমান কমিটির ২ জন সদস্য বশিরুল ইসলাম ভূইয়া (বাচ্চু মেম্বার) ও সালাইদ্দীন জুয়েলের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। সাক্ষাৎকারে বাচ্চু মেম্বার বলেন, নবীনগর এলাকার শারমিন আক্তার নামে একজনন মিডওয়াইফ এই কেন্দ্রে কেন্দ্র ব্যবস্থাপনা কমিটিকে না জানিয়ে মৌখিকভাবে নিয়োগ দিয়েছেন এবং তাকে প্রতি মাসে নগদ ৪৫০০/- টাকা হিসাবে বেতন প্রদান করতে হচ্ছে।

সালাউদ্দীন জুয়েল বলেন যে, তিনি আমাদের ও সকল স্টাফদেরকে বিনা কারণে গালিগালাজ করেন। ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল কাইয়ুম ভূইয়া বলেন, ডা. শাহানা জাফর কাউকে মানুষ মনে কনে না। সকলের সঙ্গে কথা কথা গালিগালাজ ও দুর্ব্যবহার করেন।

ডা. শাহানা জাফরের গুরু চুরি ও গরুভাড়া দেয়া: ২০১৭ সালে হাসপাতাল প্রাঙ্গনে কোরবানীর গরু রাখা এবং গরু চুরির বিষয়ে অভিযোগ তোলেন শহীদ ময়েজ উদ্দীন রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতাল, বাংলাবাজার, ঢাকা’র স্থানীয় বাসিন্দারা। এ প্রেক্ষিতে সে সময়ে কর্মরত দুইজন নিরাপত্তা প্রহরী আজিজুল হক ও মো: নজরুল ইসলাম এর লিখিত জবাববন্দি গ্রহণ করে তদন্ত কমিটি।

তদন্ত কমিটিকে নিরাপত্তা প্রহরী আজিজুল হক বলেন, হাসপাতাল কম্পাউন্ডে ডা, শাহানা জাফরের নির্দেশে তিনি প্রতিটি গরু রাখা বাবদ ৩০০/- টাকা হিসাবে আদায় করেন যা পরিবানুর (তৎকালীন মিডওয়াইফ) নিকট জমা দেন। পরবর্তীতে ৩টি গরু চুরি গেলে আমার কাছ থেকে জোর-জবরদস্তি করে জরিমানা বাবদ ৩০,০০০/- টাকা আদায় করা হয়। এছাড়াও খালি চেকে স্বাক্ষর নেয়া হয়।

নিরাপত্তা প্রহরী নজরুল ইসলাম বলেন, ১ রাতের জন্য ৪৫/৫০টি গরু রেখে প্রতি গরু হতে ৩০০/-টাকা হিসাবে  আদায় করা হয় এ সময় ৩টি গরু চুরি হয়। যার কারণে ৩০,০০০/- টাকা জরিমানা করা হয় এবং ১টি খালি চেকে স্বাক্ষর নেয়া হয়।

বিলকিছ বেগম, মিডওয়াইফ। তিনি টেলিফোনে জানান, ডাক্তার শাহানা জাফরের নির্দেশে নৈশপ্রহরীগন বিগত ৬/৭ বছর যাবৎ ৫০-১০০টি গরু হাসপাতাল ক্যাম্পাসে রেখে প্রতি রাতের জন্য প্রতিটি গরুর ভাড়া বাবদ ৫০০/- টাকা হিসাবে ২/৩ রাতের জন্য ভাড়া ১৫০০/- টাকা আদায় করেন। সেই হিসাবে প্রতি কোরবানীর মৌসুমে লাখ লাখ টাকা গরু রাখার ভাড়া বাবদ আদায় করেন ডা. শাহানা জাফর। গরু রাখার প্রাপ্ত ভাড়া থেকে সামান্য টাকা আমাকে ও নৈশ প্রহরীদের দিতেন। ২০১৭ সালে গরু প্রতি ৩০০/- টাকা হিসাবে আদায় করে মোট ১ রাতের ভাড়া ৭০,০০০/- (সত্তর হাজার) টাকা আদায় করেন ডা: শাহানা জাফর। টাকা নেয়ার পরের রাতে ৩টি গরু চুরি হয় এবং হেড অফিস কর্তৃপক্ষ জানতে পারে। ডা: শাহানা জাফর ভাড়ার টাকা আত্মসাৎ করলেও নৈশ প্রহরী আজিজুল হক ও নজরুলের কাছ থেকে ক্ষতিপূরুণ আদায় করেন।

তারা আরও জানান, ডা. শাহানা জাফরের নির্দেশনা অনুযায়ী হাসপাতালে গরু রাখা হয়। এখানে উল্লেখ্য যে, গরু রাখার জন্য তিনি কর্তৃপক্ষের কোন রকম অনুমোদন গ্রহণ করেনি। যা ইতোপূর্বে পরিচালক, ডিআরএম, বেলাল হোসেন তাঁর তদন্তে উল্লেখ করেছেন। কোন অবস্থাতেই হাসপাতাল প্রাঙ্গনে গরু রাখার মত বিষয় গ্রহণযোগ্য হতে পারেনা এতে সোসাইটি ও হাসপাতালের সুনাম ক্ষুন্ন হয়েছে।

তদন্ত কমিটি তদন্ত প্রতিবেদনে অভিযোগের সত্যতার প্রমাণ পান এবং প্রতিবেদনের প্রদত্ত তথ্যাবলী বিবেচনা ও পর্যালোচনাপূর্বক  প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেন।

অভিযোগ সম্পর্কে ডা. শাহানা জাফরের জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি আমার পেশাগত দায়িত্বে অবহেলা করিনি, এর বাইরে আমার কোনো বক্তব্য নেই।



What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow