পাকিস্তানের রাজনীতিতে উত্তেজনা
পাকিস্তানের রাজনীতিতে উত্তেজনা
মেয়াদ পাঁচ বছর পূর্ণ হওয়ার তিন দিন আগে (৯ আগস্ট) প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফের পরামর্শে পাকিস্তানের সংসদের নিম্নকক্ষ জাতীয় পরিষদ (এনএ) ভেঙে দেন দেশটির প্রেসিডেন্ট আরিফ আলভি। জাতীয় পরিষদ ভেঙে দেওয়ার তিন দিনের মধ্যে দেশটির অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আনোয়ার-উল-হক কাকারের নাম ঘোষণা করা হয়েছে। তার নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেশটির আগামী সাধারণ নির্বাচনের আয়োজন করবে।
সংসদ ভেঙে দেওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার বিধান রয়েছে পাকিস্তানে। কিন্তু সাংবিধানিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটে জেরবার দেশটিতে নির্বাচনের তারিখ নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
কাকার ও তার মন্ত্রিসভা জাতীয় নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত সরকার পরিচালনা করবে। নির্বাচনে বিজয়ী রাজনৈতিক দল সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন ও নতুন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন করবে। দেশটির চলমান পরিস্থিতি এবং আগামী কয়েক মাস সেখানে কী ঘটবে তা নিয়ে কিছু প্রশ্ন রয়েছে। এসব প্রশ্নের জবাব খোঁজার চেষ্টা করেছে ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
• নির্বাচন কি পেছাবে?
কাকারের তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে আগামী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করতে হবে। তবে দেশটির বিদায়ী সরকার শেষের দিকে নতুন আদমশুমারির অনুমোদন দেওয়ায় এখন নির্বাচন কমিশনকে নতুন করে নির্বাচনী সীমানা নির্ধারণ করতে হবে।
পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশনের সাবেক একজন কর্মকর্তার মতে, ২৪ কোটি ১০ লাখ মানুষের দেশটির শত শত ফেডারেল ও প্রাদেশিক নির্বাচনী আসনে নতুন সীমানা নির্ধারণে ছয় মাস বা তারও বেশি সময় লাগতে পারে।
এই কাজ শেষ করতে কত সময় লাগবে তা নির্বাচন কমিশনকে ঘোষণা করতে হবে। কারণ নির্বাচনী আসনের নতুন সীমানা নির্ধারণ নিয়ে প্রার্থীরা মামলা-মোকদ্দমাও করতে পারেন। এর ভিত্তিতে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা দিতে হবে।
• তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভূমিকা কী?
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়-দায়িত্ব সাধারণত নির্বাচন তদারকির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু কাকারের সরকার পাকিস্তানের ইতিহাসে সবচেয়ে ক্ষমতাবান। কারণ দেশটির বিদায়ী সরকার শেষের দিকে একটি আইনে পরিবর্তন এনেছে। এর ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেশটির অর্থনৈতিক বিষয়েও নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারবে। যা আগের কোনও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ছিল না।
গত জুনে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে ৯ মাস মেয়াদী ৩৫০ কোটি ডলারের বেলআউট পাওয়ার লক্ষ্যে পাকিস্তানের সরকার ওই পদক্ষেপ গ্রহণ করে। আইএমএফের তিন দফার বেলআউট পর্যালোচনার অন্তত একটি হবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ক্ষমতার মেয়াদেই এবং নির্বাচন বিলম্বিত হলে তা আরও বেশি হতে পারে।
আইএমএফ ইতিমধ্যে নীতি নির্দেশনার বিষয়ে পাকিস্তানের সব রাজনৈতিক দলের সমর্থন পেয়েছে।
• সেনাবাহিনীর ভূমিকা কি?
পর্দার আড়ালে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর এখনও বিশাল ভূমিকা রয়েছে। স্বাধীনতা লাভের ৭৬ বছরের ইতিহাসে তিন দশকেরও বেশি সময় সরাসরি পাকিস্তানকে শাসন করেছে দেশটির সামরিক বাহিনী। দেশটির রাজনীতিতে ব্যাপক ক্ষমতার চর্চা করে এই বাহিনী।
কাকারের রাজনৈতিক দল বেলুচিস্তান আওয়ামী পার্টিকে (বিএপি) সামরিক বাহিনীর ঘনিষ্ঠ বলে মনে করা হয়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন, যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকার তার সাংবিধানিক মেয়াদ অতিক্রম করে, তাহলে নির্বাচিত সরকার ছাড়া দেশটিতে দীর্ঘসময় সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ আরও সুসংহত হবে।
• নির্বাচনে লড়বেন ইমরান খান?
চলমান পরিস্থিতি অনুযায়ী, দেশটির প্রধান বিরোধীদলীয় নেতা সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান এবারের নির্বাচনে লড়াই করতে পারবেন না।
বর্তমানে দুর্নীতির অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হয়ে তিন বছরের জন্য সাজা খাটছেন ইমরান খান। একই সঙ্গে তাকে আগামী পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
তার রাজনৈতিক দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) ২০১৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভ করেছিল এবং ২০২২ সালের অনাস্থা ভোটে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগে পর্যন্ত ইমরান খান প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।
• প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী কারা?
দেশটির পরবর্তী সরকারের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য তিনটি প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দল রয়েছে। দলগুলো হলো ইমরান খানের পিটিআই, শেহবাজ শরিফের পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজ (পিএমএল-এন) এবং পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি)।
ইমরান খান কারাগারে এবং নির্বাচনে নিষিদ্ধ হওয়ায় সমর্থকদের সহানুভূতি ও ক্ষোভকে কাজে লাগাবে পিটিআই। এর ফলে ২০১৮ সালের নির্বাচনের জয়ের পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে দলটির। কিন্তু সামরিক বাহিনীর সাথে অব্যাহত অচলাবস্থার মাঝে পিটিআইয়ের এই সম্ভাবনা অনেকটা জেনারেলদের ওপর নির্ভর করছে। যা প্রায় অসম্ভব বলে মনে করা হচ্ছে।
দেশটির বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফের ভাই তিনবারের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ। পিএমএল-এনের বিদায়ী জোট সরকারের জ্যেষ্ঠ অংশীদার ছিলেন নওয়াজ। তিনি নির্বাসন থেকে দেশে ফিরে আসতে চাইছেন। দুর্নীতির সাজা বহাল থাকলেও শেহবাজ ক্ষমতায় ফেরার দৌড়ে এগিয়ে রয়েছেন।
পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোর ছেলে ও পিপিপির তরুণ চেয়ারম্যান বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি (৩৪) আরেক গুরুত্বপূর্ণ প্রার্থী। দেশটির বিদায়ী সরকারে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসাবে তার প্রথম দায়িত্বে থাকাকালীন দেশে ও বিদেশে ব্যাপক সাড়া ফেলেছিলেন। তাকে দেশটির ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দেখা হয়।
• নির্বাচনী চ্যালেঞ্জ কেমন?
স্বাধীনতা লাভের পর এবারই প্রথম নজিরবিহীন অর্থনৈতিক সংকেটের মুখোমুখি হয়েছে পাকিস্তান। অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে গত জুনে আইএমএফের কাছ থেকে ৩৫০ কোটি মার্কিন ডলারের বেলআউট প্যাকেজ পেলেও দেশটির অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠাই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আইএমএফের পরামর্শে অর্থনৈতিক সংস্কার আনায় দেশটিতে ইতিমধ্যে রেকর্ড মুদ্রাস্ফীতি ঘটেছে এবং সুদের হার ব্যাপক বৃদ্ধি করা হয়েছে।
ইমরান খানের কারাদণ্ড ও নিষেধাজ্ঞার পর দেশটিতে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা তৈরি হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। যদিও তাকে গ্রেপ্তারের পর দেশটিতে কোনও ধরনের সহিংসতা দেখা যায়নি। গত মে মাসে প্রথমবার গ্রেপ্তার হওয়ার পর ইমরান খানের সমর্থকরা দেশজুড়ে তাণ্ডব চালিয়েছিল। কিন্তু তাকে কারাবন্দী করে রাখা হলে তা দেশটির আগামী নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলবে।
আর নির্বাচন যদি ৯০ দিনের মধ্যে অনুষ্ঠিত না হয়, তাহলে সাংবিধানিক ও আইনি প্রশ্ন আসবে। সাংবিধানিক প্রশ্নে দেশটির সুপ্রিম কোর্টের কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার নজির রয়েছে।
What's Your Reaction?