জামায়াত ও চীন হবে আগামী নির্বাচনের ট্রাম্পকার্ড?
জি-২০ সম্মেলনে যোগদানের লক্ষ্যে আগামী সপ্তাহে ভারত সফরে আসছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দেখা করাই তার এ সফরের প্রাথমিক লক্ষ্য।
শেখ হাসিনা আশা করছেন, বাংলাদেশকে ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তা দেবে ভারত। এটি নভেম্বরে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল থেকে ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি পাওয়ার শর্ত পূরণে ঢাকাকে সহায়তা করবে। বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এ ঋণ আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
চলতি বছরের জুলাইয়ে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নেমে দাঁড়িয়েছে ২৩ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন ডলার। এই অর্থে বাংলাদেশ মাত্র চার মাসের আমদানি ব্যয় মেটাতে পারবে। ক্ষমতাসীন দলের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের বড় অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা ছাড় দেওয়ার পরেই এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
আইএমএফের ঋণের পরবর্তী কিস্তি পেতে বাংলাদেশকে ২৪ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভের শর্ত পূরণ করতে হবে। আইএমএফের এই ঋণ বাংলাদেশের প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার কাছে সামান্য চিনাবাদামের সমতুল্য। তবে এই ঋণ আওয়ামী লীগ সরকারের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার একটি বৈধতা প্রদান করবে এবং চীনসহ অন্যান্য উৎস থেকে ঋণপ্রাপ্তির দরজা খুলে দেবে।
চলতি মাসের শুরুতে ব্রিকস সম্মেলনে যোগ দিতে জোহানেসবার্গ সফর করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশ ব্রিকস জোটে যোগ দিতে যাচ্ছে বলে একটি উচ্চাশা তৈরি হয়েছিল বাংলাদেশে। তবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর আসল উদ্দেশ্য ছিল চীনা প্রেসিডেন্ট শি-জিনপিংয়ের সঙ্গে দেখা করা। ২৪ আগস্ট প্রকাশিত এক চীনা সরকারি বিবৃতি অনুসারে বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল। বাংলাদেশ সূত্র বলছে, নির্বাচনের আগে ঢাকাকে বড় ধরনের ঋণ দেবে বেইজিং। এদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সমর্থকরা ব্রিকসে যোগদানে বাংলাদেশের পথ রুদ্ধ করার জন্য ভারতকে দোষারোপ করছে। ব্রিকস সম্মেলনের কয়েক সপ্তাহ আগে, বাংলাদেশের সংবাদপত্রগুলো ‘চীনা নেতৃত্বাধীন’ আঞ্চলিক অর্থনৈতিক অংশীদারিত্বে (আরসিইপি) বাংলাদেশের যোগদানের ‘সিদ্ধান্ত’ নিয়েছে সরকার। স্পষ্টতই এটি ভারতকে লক্ষ্য করে একটি অকার্যকর দাবি।
বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির একটি ভিত্তি রয়েছে। আর সেখানে ভারত সবসময়ই একটি বুদ্ধিজীবী শ্রেণির প্রতিনিধিদের দ্বারা চালিত রাষ্ট্র। ২০০১-০৬ সময়কালে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এবং জামায়াতে ইসলামীর সরকারের সঙ্গে ভারতের খারাপ অভিজ্ঞতা শেখ হাসিনাকে দিল্লির একমাত্র মিত্র হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করতে সাহায্য করেছিল।
ফলে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের নির্বাচনের কয়েক দিন আগে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং জামায়াতকে ক্ষমতার বাইরে রাখার জন্য তার প্রচেষ্টার কথা বাংলাদেশি মিডিয়াকে বলেছিলেন। ২০১৩ সালের আগস্টে আদালতের রায়ে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছিল।
সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৩০০টি আসনের মধ্যে ১৫১টিতে জিতেছিল বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। কারণ আওয়ামী লীগের চির প্রতিদ্বন্দ্বী এবং বাংলাদেশের প্রধান বিরোধীদল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) জামায়াতের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত ছিল। অতঃপর আওয়ামী লীগ ভারতীয় সমর্থন গ্রহণ করে ক্ষমতায় টিকে যায়।
বাংলাদেশের বিদ্যমান সরকার আশা করেছিল, ইসলামপন্থিরা দলটির জনপ্রিয়তার অভাব পূরণ করবে এবং চীন টাকার ব্যাগ নিয়ে হাজির হবে। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে অনেক ভালোভালো প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। কিন্তু নির্বাচন শেষে কাজ করা হয় ঠিক তার উল্টো।
এ পর্যন্ত বাংলাদেশকে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার আর্থিক সহায়তা দিয়েছে ভারত। এর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন প্রকল্পে ৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ, রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে ১ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলারের স্বল্প সুদের ঋণ। তবে এর ফল ভারতের জন্য খুব বেশি উৎসাহজনক নয়। অনেক ভারতীয় প্রকল্প শেষ হতে চীনা প্রকল্পের তুলনায় অত্যধিক বেশি সময় নিচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতির কারণে বাংলাদেশ কয়লা কিনতে না পারায় রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রথম ইউনিটটি নিয়মিত বিরতিতে অচল থাকে। প্রকল্পটি প্রমাণ করে বাংলাদেশ একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক অর্থনীতি তৈরি করেছে যা ভারতীয় প্রকল্পের বিরোধী। তারা চীনের পক্ষে। কারণ চীনা প্রকল্পগুলো খরচ বৃদ্ধির মাধ্যমে সহজে অর্থ পাওয়ার দরজা খোলা রাখে।
গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশে রাজনীতি ব্যাপকভাবে ব্যবসায়ীদের কবলে পড়ে। তারা ব্যাংক থেকে বিনা বাধায় ঋণ নিয়েছে। সেই ঋণ পরিশোধ না করে খেলাপি হয়েছে। ব্যাপকভাবে অর্থ পাচার করেছে। একই সঙ্গে ব্যবসায়ীদের মিডিয়া সাম্রাজ্য চীনের পক্ষে জনমত গঠনে ভূমিকা রেখেছে।
রাজনৈতিক ফ্রন্টে আওয়ামী লীগসহ প্রতিটি সংগঠনে জামায়াত অনুপ্রবেশ করেছে। তারা হেফাজতে ইসলামের নেতৃত্ব নিয়ন্ত্রণ করছে। হেফাজতে ইসলাম একটি অরাজনৈতিক সংগঠন যেখানে মাদ্রাসা ছাত্র ও শিক্ষকদের একটি বিশাল সমাবেশ রয়েছে। আওয়ামী লীগ এরই মধ্যে হেফাজতের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করেছে এবং তাদের সব দাবি পূরণ করছে। জামায়াত ও চীন বাংলাদেশের ওপর তাদের প্রভাব জোরদার করেছে। আর ঢাকা সেই জামায়াত এবং চীনকে ভারতের বিরুদ্ধে তুরুপের তাস হিসেবে ব্যবহার করছে।
তাত্ত্বিকভাবে জামায়াতের নির্বাচনে ফিরে আসার আইনি বাধা দূর হয়েছে। কারণ তারা দলীয় গঠনতন্ত্র সংশোধন করেছে এবং নাম পরিবর্তন করেছে। দিল্লি তাদের মাঠে ফিরাতে আগ্রহী নয়। তবে দলটি দিল্লির জন্য একটি বিরাট ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
বিএনপির নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া জেল খাটছেন এবং তার ছেলে তারেক রহমান প্রবাসে থাকায় বিএনপি দুর্বল। ফলে বিরোধী দলের জন্য জামায়াতের সমর্থন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাদের পথ আটকে দিলে বাংলাদেশে ভারতের ভাবমূর্তি আরও ক্ষুণ্ন হবে। জামায়াতকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করলে তারা অন্য ছোট ইসলামী দলগুলোর সঙ্গে জোট গঠন করতে পারে। এটি তাদের পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতায় আনতে পারে, যা প্রতিবেশী এবং সহযোগী দেশটির সাথে ভারতের স্বার্থ কল্পনাতীতভাবে নষ্ট করতে পারে। সুতরাং তাকে হারানোর চেয়ে শত্রুর মুখোমুখি হওয়া কি উত্তম নয়?
What's Your Reaction?