বিএনপির বঞ্চিতরা টার্গেটে বিএনএম ও হুদার দলের
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সাংগঠনিক কার্যক্রম জোরদার করতে তৎপরতা শুরু করেছে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পাওয়া নতুন দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বিএনএম) এবং তৃণমূল বিএনপি।
দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নিলে সর্বোচ্চসংখ্যক আসনে প্রার্থী দিতে চায় দল দুটি। তার আগেই বিএনপিসহ বিভিন্ন দল থেকে রাজনৈতিক মহলে পরিচিত ও জনপ্রিয় নেতাদের দলে ভিড়িয়ে সাংগঠনিক শক্তি বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। এ ক্ষেত্রে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বিএনপির সংস্কারপন্থি অংশ এবং পরবর্তী সময়ে যারা নানাভাবে বঞ্চিত কিংবা ক্ষুব্ধ নেতাদের টার্গেট করা হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
নতুন দল গঠনের প্রক্রিয়ায় যুক্ত একাধিক সূত্রে জানা গেছে, বর্তমান সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্তে বিএনপি অনড় অবস্থানে রয়েছে। সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের একদফা দাবিতে যুগপৎ আন্দোলন করছে দলটি। অন্যদিকে বিদ্যমান সংবিধানের আওতায় বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনের প্রশ্নে কোনো ছাড় দিতে রাজি নয় আওয়ামী লীগ। এ অবস্থায় শেষ পর্যন্ত বিএনপিকে হয়তো নির্বাচন বর্জনের পথই বেছে নিতে হবে। সে ক্ষেত্রে দলটির বিভিন্ন স্তরের নেতাদের ভোটের মাঠে নিয়ে আসার পরিকল্পনা নিয়ে একাধিক নতুন দল সক্রিয় হয়েছে। বিএনএম ও তৃণমূল বিএনপি এরই মধ্যে বিএনপির অনেক নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে।
রাজনীতিতে আলোচনা আছে, আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে কেন্দ্র থেকে স্থানীয় পর্যায় পর্যন্ত বিএনপির অর্ধশত নেতাকে টার্গেট করেছে তৃণমূল বিএনপি ও বিএনএম। বিএনপিতে দীর্ঘদিন ধরে নিষ্ক্রিয়, পদবঞ্চিত, সাবেক মন্ত্রী-এমপি এবং এক সময় সংস্কারপন্থি হিসেবে পরিচিত এমন অনেকে রয়েছেন এ তালিকায়। এরা ভেতরে ভেতরে এসব দলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। এ ছাড়া জ্যেষ্ঠ অনেক নেতা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। বিএনপির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী এবং বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত চেয়ারপারসনের সাবেক উপদেষ্টা তৈমূর আলম খন্দকার তৃণমূল বিএনপিতে যোগ দিচ্ছেন। বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পর আরও কে কে দল ছাড়ছেন—বিএনপিতে এ নিয়ে কানাঘুষা শুরু চলছে।
তবে একাধিক সূত্রের দাবি, বিএনপি থেকে তেমন কেউ বিএনএমে যাবেন না। তবে তৃণমূল বিএনপির ব্যানারে নির্বাচন যেতে পারেন বেশ কয়েকজন নেতা। তবে বিএনপি ভেঙে ওই দুটি দলে নেতাকর্মীদের ভাগিয়ে নিতে বিভিন্ন পর্যায়ে তৎপরতা চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বিএনপি নেতারা বলছেন, অতীতে বহুবার বিএনপিকে ভাঙার ষড়যন্ত্র করা হয়েছে; কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীরা প্রতিবারই ব্যর্থ হয়েছে। বিএনপিতে ভাঙন ধরাতে পারেনি, আগামীতেও পারবে না। তাদের দাবি, সরকারি হামলা-মামলা, জেল-জুলুম, নির্যাতন সত্ত্বেও কেউ বিএনপি ছাড়েননি। এটাই বিএনপির মূল শক্তি। সরকার নানাভাবে বিভ্রান্তি তৈরির জন্য এসব করার চেষ্টা করে বলে দাবি তাদের।
এ প্রসঙ্গে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘বিএনপি একটা বিশাল প্রবহমান নদীর মতো। কেউ চলে গেলে তাতে দলের কিছু আসবে যাবে না।’ তিনি বলেন, ‘তৈমূর আলম খন্দকার এখন আমাদের দলের সদস্য নন, শমসেন মবিন চৌধুরীও আমাদের দলের সদস্য নন। সুতরাং তারা তাদের মতো করে সিদ্ধান্ত নিতেই পারেন। এটা তাদের ব্যাপার।’ অবশ্য অন্য কোনো দল ভাঙার তৎপরতার কথা দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করেছেন বিএনএম ও তৃণমূল বিএনপির নেতারা। তাদের দাবি, তারা একটি কল্যাণমূলক রাষ্ট্র গঠন করতে চান। যারাই এই লক্ষ্য নিয়ে কাজ করতে চান, তাদের সবার জন্য দলের দরজা খোলা থাকবে। কোনো দলকে ভাঙা বা গড়া তাদের লক্ষ্য নয়।
বিএনপি ভাঙার প্রসঙ্গ উড়িয়ে দিয়ে তৃণমূল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান অন্তরা হুদা কালবেলাকে বলেন, ‘বিএনপি ভাঙার কোনো ইচ্ছা আমাদের নেই। বিএনপি তাদের রাজনীতি করবে, আমরা আমাদের রাজনীতি করব। তৃণমূল বিএনপি একটি নতুন রাজনৈতিক দল। আমরা একটি কল্যাণমূলক রাষ্ট্র গড়তে চাই। এক্ষেত্রে আমরা সবার সহযোগিতা চাই। তৃণমূল বিএনপির দরজা সবার জন্য খোলা।’ বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য পরবর্তী সময়ে দল থেকে বহিষ্কৃত ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা ‘তৃণমূল বিএনপি’ প্রতিষ্ঠা করেন। গত ১৬ ফেব্রুয়ারি দলটিকে নির্বাচন কমিশন নিবন্ধন দেয়। এর কয়েকদিন পর তিনি মারা গেলে দলের নেতৃত্বে আসেন তার মেয়ে ব্যারিস্টার অন্তরা হুদা।
অন্যদিকে বিএনএমের যুগ্ম আহ্বায়ক ও মুখপাত্র ব্যারিস্টার এম সরোয়ার হোসেন কালবেলাকে বলেন, ‘আমরা মনে করি, বর্তমান রাজনীতি পুরোপুরি দুর্বৃত্তায়িত হয়ে গেছে। এখানে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ বড় দলগুলোর মধ্যে কার্যত কোনো পার্থক্য নেই। সেই ক্ষেত্রে যারা বর্তমানে এই দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতির অংশ এবং যারা ভবিষ্যতেও এই রাজনীতির মাধ্যমে আবার কোনো না কোনোভাবে লুটপাটে অংশগ্রহণ করবে— তারা আমাদের টার্গেট নয়। বরং যারা এ দেশে স্বাধীনতার চেতনায় গণতন্ত্র, সুশাসন, ন্যায়বিচার দেখতে চায়; স্বচ্ছ রাজনীতি চায়, দুর্নীতির মূলোৎপাটন ঘটাতে চায়, বাংলাদেশকে একটি কল্যাণ রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চায়, রাজনীতিবিদদের জবাবদিহি দেখতে চায় এবং যারা মৃত্যুর পর তাদের সন্তান, আত্মীয়স্বজনকে এদেশে নিরাপদে রাখতে চায়, তারা আমাদের টার্গেট, তাদের প্রতি আমাদের আহ্বান। বিএনএমের দরজা তাদের জন্য সবসময় খোলা।’
তিনি দাবি করেন, ‘বিএনপি বা অন্য কোনো দল ভাঙা বা গড়া আমাদের লক্ষ্য নয়। ভালো মানুষকে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত করে একটি কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করাই আমাদের লক্ষ্য।’সূত্রের দাবি, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপির পাঁচ ক্যাটাগরির নেতাকে টার্গেট করেছে তৃণমূল বিএনপি ও বিএনএম। এর মধ্যে আছেন ওয়ান-ইলেভেনের পর সংস্কারপন্থি হিসেবে পরিচিতি পাওয়া নেতারা। দ্বিতীয়ত, বিএনপির সাবেক অনেক মন্ত্রী ও এমপি আছেন, যারা বর্তমানে রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় এবং দলে গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছেন। এ ছাড়া বহিষ্কৃত হওয়ায় নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়া অনেক নেতাকেও টার্গেট করেছে তারা। তৃতীয়ত, বিভিন্ন সময়ে গঠিত বিএনপির নানা পর্যায়ের কমিটি বিশেষ করে জেলা কমিটি থেকে অনেকে বাদ পড়েছেন। কমিটিতে স্থান না পাওয়ায় ক্ষোভ, অভিমানে তারা এখন রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয়। বিএনপির এসব নেতাদেরও টার্গেট করেছে দল দুটি। আবার বিএনপির সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর সম্পর্ককে অনেকে পছন্দ করেন না, ভালোভাবে নেন না। কিন্তু পদ হারানোর ভয়ে প্রকাশ্যে বিরোধিতাও করতে পারেন না। তারাও ওই দুটি দলের টার্গেটে রয়েছেন। এ ছাড়া বিএনপিতে একটি গ্রুপ রয়েছে যারা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বকে সেভাবে পছন্দ করেন না, মেনে নিতে পারেন না। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে কোনো ধরনের ঝুঁকিও নিচ্ছেন না। বর্তমানে সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন তারা। দলের এসব সিনিয়র নেতার কাউকে কাউকে টার্গেট করেছে তৃণমূল বিএনপি ও বিএনএম।
জানা গেছে, তৃণমূল বিএনপিতে যোগদান করে রাজনীতিতে আবার সরব হতে যাচ্ছেন সাবেক বিএনপি নেতা শমসের মবিন চৌধুরী ও অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার। আজ মঙ্গলবার রমনার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে তৃণমূল বিএনপির প্রথম কাউন্সিলে দলটিতে যোগ দিতে পারেন তারা।
এ ছাড়া রাজনৈতিক অঙ্গনে গুঞ্জন রয়েছে, বিএনপি থেকে বিভিন্ন সময় বাদ পড়া এবং ক্ষোভ-অভিমানে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়া অনেক নেতাও গত ১৬ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পাওয়া তৃণমূল বিএনপিতে যোগ দিতে পারেন। এ তালিকায় বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনের সংসদ সদস্য উকিল আবদুস সাত্তারও রয়েছেন। বর্তমান জাতীয় সংসদে তিনি বিএনপির এমপি ছিলেন। আন্দোলনের অংশ হিসেবে গত ডিসেম্বরে বিএনপির এমপিরা সংসদ থেকে পদত্যাগ করার পর দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে উপনির্বাচন করায় তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। তিনি বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ছিলেন।
এসব বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান বলেন, ‘বিএনপি তো বাকশাল নয়। বিএনপি সবাইকে স্বাধীনতা দেয়, যার যার ইচ্ছামতো রাজনীতি করবে। যারা বিএনপি করতে চায় করবে, যারা নতুন দল করতে চায় করবে।’ বিএনপির অনেক নেতা তৃণমূল বিএনপিতে যোগ দিতে পারেন—এ ধরনের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাদের দল থেকে পদত্যাগ করে তো একজন যোগ দিয়েছেন সংসদে। তাতে রাজনীতিতে কি কোনো পরিবর্তন এসেছে, কোনো মৌলিক পরিবর্তন এসেছে, সরকারের এতে কি বিরাট বিজয় হয়েছে?’ দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী কালবেলাকে বলেন, ‘জনগণের ভালোবাসা ও সমর্থনে বিএনপি একাধিকবার রাষ্ট্রক্ষমতায় গেছে। জনগণই বিএনপির প্রধান শক্তি। অতীতে বহুবার বিএনপিকে ভাঙার চেষ্টা করা হয়েছে; কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীরা সফল হয়নি। বিএনপিতে ভাঙন ধরাতে পারেনি।’
বিএনপি থেকে নানা কারণে বহিষ্কৃত বা অব্যাহতিপ্রাপ্ত কোনো কোনো নেতা নতুন দলে যোগ দিতে পারেন—রাজনীতিতে এমন গুঞ্জন রয়েছে। তবে এমন কারও বিষয়েই সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি। এ ধরনের কোনো সম্ভাবনাকে নাকচ করে বিএনপির অব্যাহতিপ্রাপ্ত খুলনা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক নজরুল ইসলাম মঞ্জু কালবেলাকে বলেন, ‘জন্মলগ্ন থেকে বিএনপিকে একটি অঞ্চলে সমৃদ্ধ করছি। সেই বিএনপি ছেড়ে কেন যাব? বিএনপির বিভিন্ন দুঃসময়ে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ৩৯ বছরে তিনটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন করেছি। বিএনপির সেই দুঃসময় এখনো কাটেনি। তাই যাই ঘটুক, খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে আমরা বিএনপি ছেড়ে যেতে পারি না।’ তিনি বলেন, ‘নানা কারণে দলে নিগ্রহ-অবহেলার শিকার হয়েছি, অসম্মানিত হয়েছি। তারপরও বলব, বিএনপি হচ্ছে আমাদের প্রাণ। সেই বিএনপি ছেড়ে আমরা যেতে চাই না, যেতে পারি না। এর পরও যদি বিএনপি আমাদের অবমূল্যায়ন করে, প্রয়োজনে অভিমান নিয়ে রাজনীতি থেকে অবসরে যাব। তবু এই দলের বিপক্ষে আমরা যেতে পারি না।’
What's Your Reaction?