বড় ভাই পুলিশ অফিসার, ছোট ভাইয়ের নিয়ন্ত্রনে সংরক্ষিত বন ও চর

Feb 25, 2024 - 12:58
 0  346
বড় ভাই পুলিশ অফিসার, ছোট ভাইয়ের নিয়ন্ত্রনে সংরক্ষিত বন ও চর
বহিস্কৃত ছাত্রলীগ নেতা এনামুল হোসাইন, ছবি: সগৃহিত

বড় ভাই নাজমুল হোসেন পুলিশের এডিসি। ভাইয়ের প্রভাব খাটিয়ে গত কয়েকবছরে বরগুনার পাথরঘাটা এলাকার বলেশ্বর তীরবর্তি একাধিক বনভূমি নিয়ন্ত্রন করেন ছোটভাই এনামুল হোসাইন। একসময় বিএনপির সহযোগী সংগঠন স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা থাকলেও পুলিশ অফিসার বড় ভাইয়ের বদৌলতে পাথরঘাটা উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ বাগিয়ে নিয়েও বিতর্কিত হয়েছিলেন। সেই বিতর্কও কাটিয়েছেন বড় ভাইয়ের ক্ষমতা আর প্রভাব ব্যবহার করে। বহিস্কৃত ছাত্রলীগ নেতা থেকে তিনি একলাফে  এখন বরগুনা জেলা পরিষদের পাথরঘাটা অঞ্চলের সদস্য।

বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার বলেশ^র ও বিষখালী তীরবর্তি বনভূমি ও বঙ্গোপসাগরের মোহনায় জেগে ওঠা একাধিক বিশাল চর দখল করে নিষিদ্ধ জাল ব্যবহার করে জেলেদের দিয়ে মাছ শিকার পাথরঘাটা জেলা পরিষদের সদস্য এনামুল হোসাইন। এতে প্রতিদিনই নির্বিচারে মারা পড়ছে নানা প্রকার সামুদ্রিক মাছের পোনা। অভিযোগ রয়েছে, সাবেক সংসদ সদস্য শওকত হাচানুর রহমান রিমনের মদদ ও আপন বড় ভাই পুলিশের বড় কর্মকর্তা পদে কর্মরত থাকায় দীর্ঘবছর ধরে এনামুল হোসাইনের বিরুদ্ধে ভয়ে কেউ মুখ খোলেনি। রাজনৈতিক ও ভাইয়ের প্রভাব খাটিয়ে তিনি স্থানীয় প্রশাসনকেও ‘ম্যানেজ’ করেই এ কারবার চালাচ্ছেন। ফলে ব্যবস্থা নেয়া তো দূরে থাক, নিয়মিত মাসোহারার বিনিময়ে মাছ ধরার সুযোগ করে দিচ্ছে নৌ পুলিশ, বন বিভাগ ও মৎস্য বিভাগের কর্মকর্তারা।


 বঙ্গোপসাগর সংলগ্ন বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার পদ্মা, রুহিতা, হরিণঘাটা তাফালবাড়িসহ বলেশ্বর নদীতীরের বিস্তির্ন বনভূমির পাশে নদীতে সাড়ি সাড়ি খুঁটি পুঁতে নিষিদ্ধ চরঘেরা জাল ব্যবহার করে মাছ শিকার করা হয়। একই প্রক্রিয়ায় বলেশ^র বিষখালী ও বঙ্গোপসাগরের মোহনায় জেগে ওঠা অন্তত ১২টি বিশাল চরের চারদিক ঘিরে অবৈধ জাল ব্যবহার করে শিকার করা হয় বাচ্চা ইলিশসহ নানা সামুদ্রিক মাছের পোনা। প্রতি অমাবশ্যা ও পুর্নিমার জো’তে নিষিদ্ধ বেহুন্দি, ঘোপ ও চরঘেরায় হাজার হাজার টন মাছের পোনা ধরা পড়ে। রাতের আঁধারে এসব মাছ বিক্রি করে দেয়া হয় পাইকারদের কাছে। পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় অন্তত ১০ জন জেলের সাথে কথা হয়। 


৩০ বছর ধরে এই অঞ্চলে মাছ শিকার করেন এমন একজন জেলে জানান, লালদিয়া, জ্ঞানপাড়া ও চরদুয়ানি থেকে শুরু করে সুন্দরবনের বেশ কয়েকটি পয়েন্ট নিয়ন্ত্রন করেন এনামুল হোসাইন। এর মধ্যে হরিণঘাটা, ধারের খাল, পদ্মা স্লুইজ, সোনাতলা, রুহিতা, হাঝির খাল, টেংরা, তাফালবাড়িয়া, জ্ঞানপাড়া চরদুয়ানীসহ আশাপাশের এলাকার নদী তীরবর্তি দুইশরও বেশী বনাঞ্চলের পয়েন্ট এনামুল হোসাইনের নিয়ন্ত্রনে। এছাড়া বলেশ^র ও বিষখালীর মোহনায় গড়ে ওঠা লালদিয়া, বিহঙ্গ দ্বীপ, হরিণঘাটা অন্তত ১২টি বিস্তির্ন চরাঞ্চলে এনামুল হোসাইনের নিয়ন্ত্রনে। একইসাথে সুন্দরবনের সুপতি, চান্দেশ্বর, কটকা, কাডামারা, ডিমেরচর, কচিখালী, নারকলেবাড়িয়া এলাকায় ও আধিপত্য বিস্তার করে অবৈধ জাল ব্যবহার করে মাছ শিকার করাচ্ছেন সাবেক এই ছাত্রলীগ নেতা। ওই জেলে জানান, কমপক্ষে দুই শতাধিক ছোট ছোট ট্রলার ও নৌকায় চরঘেরা, বেহুন্দি, চিংড়ীজাল ও ট্রলিতে এসব মাছ শিকার করা হয়। এরপর সেই মাছ পাথরঘাটার রুহিতা, পদ্মা, জ্ঞানপাড়া, চরদুয়ানী, টেংরা এলাকায় রাতের আঁধারে বিক্রি হয়। এরপর পাইকারদের হাত ঘুরে কিছু অংশ চলে যায় শুঁটকি প্রক্রিয়াজাতকারীদের কাছে। বাকি মাছ দেশের বিভিন্ন স্থানে চালান করে দেয়া হয়। 


নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরেক জেলে বলেন, এনামুল হোসাইন প্রভাব বিস্তার ও উৎকোচের বিনিময়ে মৎস্য, বন বিভাগ ও নৌপুলিশকে ম্যানেজ করে নিষিব্ধ জাল ব্যবহার করে মাছ শিকার করাচ্ছেন। সাধারণ জেলেরা কেউ এনামুলের ভয়ে মুখ খোলেনা। বরং তার নিয়ন্ত্রনে থেকে অবৈধ জাল ব্যবহার করে মাছ শিকার করে অনেকের অবস্থার উন্নতি হয়েছে। কেউ এনামুল হোসাইনের বিরুদ্ধে মুখ খুললেই তাকে হেনস্তা হতে হয়। এনামুলের এমন প্রভাবের পেছনে মূল শক্তি ও মদদদাতা দুজন। একজন তার আপন বড় ভাই শ্যমলী জোনের এডসি নাজমুল হোসাইন আরেকজন স্থানীয় সাবেক সংসদ সদস্য শওকত হাচানুর রহমান রিমন। তবে এবার রিমন নির্বাচিত না হলেও ভাইয়ের প্রভাবে আধিপত্য টিকিয়ে রেখেছেন এনামুল। 


কে এই এনামুল হোসাইনঃ এনামুল হোসাইনের বাড়ি বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার চরদুয়ানী ইউনিয়নের তাফালবাড়িয়া গ্রামে। তার বাবা নাম মাসুম মিয়া ছিলেন চরদুয়ানি ইউনিয়ন বিএনপির সহ সভাপতি ও একজন ইউপি সদস্য। তিনি তৎকালীন বিএনপির এমপি নুরুল ইসলাম মনির ঘনিষ্ট ও আস্থাভাজন ব্যক্তি। ছাত্রজীবনে ছাত্রদলের সক্রীয় সদস্য ছিলেন তিনি। ২০১০ সালে উপজেলা যুবদলের সদস্য এবং ২০১৩ সালে সেচ্ছাসেবক দলের আইন বিষয়ক সদস্য ছিলেন এনামুল হোসেন। রাজধানীর শ্যামলী জোনের এডিসি নাজমুল হোসেনর আপন ছোট ভাই এই এনামুল। ভাইয়ের প্রভাব খাটিয়ে ২০১৬ সালে বাগিয়ে নেন পাথরঘাটা উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ। এরপর বিএনপির রাজনীতি থেকে উঠে আসা এনামুল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়ায় বিতর্ক সৃষ্টি হয় এবং ২০১৯ সালের অক্টোবর মাসে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়। কিন্ত স্থানীয় সংসদ সদস্য শওকত হাচানুর রহমান রিমনের সহায়তায় ডিসেম্বর মাসে পদ ফিরে পান এনামুল। ভাইয়ের প্রভাব আর এমপি রিমনের প্রত্যক্ষ মদদে এলাকায় ‘এনামুল বাহীনি’ নামের একটি বাহীনি গড়ে তুলেছেন তিন। একসময় এমপি রিমনের ডান হাত বনে যান এনামুল হোসাইন। রিমনের মদদে প্রশাসন থেকে শুরু করে রাজনীতিক ও সাধারণ মানুষও জিম্মি হয়ে পড়ে তার কাছে। এক সময়ে মানবেতর জীবন যাপন করা এনামুলের পরিবার হঠাৎই হয়ে ওঠেন অঢেল অর্থ বিত্তের মালিক। অভিযোগ রয়েছে, ভাইয়ের প্রভাব খাটিয়ে নিজস্ব সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে ব্যক্তি মালিকানার জমি দখল, সরকারি জমি দখল করে মাছের ঘের নির্মাণ, অবৈধভাবে মাছ ধারার সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ, বিএফডিসির সাধারণ সম্পাদকের পদ বাগিয়ে নিয়ে সিন্ডিকেট তৈরি করেন এনামুল। ইন্ডিয়া থেকে ক্রয় করা দুটি ট্রলিং ট্রলার, ৪টি মাছের ট্রলার, দুটি বরফ মিলসহ অঢেল সম্পত্তির মালিক এখন এই এনামুল হোসাইন। সবশেষ জেলা পরিষদ নির্বাচনে পাথরঘাটা এলাকার সদস্য নির্বাচিত হন তিনি।

বরগুনা জেলা মৎস্যজীবী ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী বলেন, দির্ঘবছর ধরে নিষিদ্ধ জাল ব্যবহার করে সামুদ্রিক মাছের পোনা নিধনযজ্ঞ চললেও কেউ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। প্রভাবশালী মহল জেলেদের ব্যবহার করে বনাঞ্চল ও চর দখল করে রমরমা বানিজ্য চালিয়ে আসছে। আমরা একাধিকবার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ দিলেও কেউ ব্যবস্থা নিতে পারেনি। নামমাত্র কিছু অভিযান হয়েছে কিন্ত সেটাও লোক দেখানো। এই চক্রকে বিরত রাখতে না পারলে আমাদের মাছের বংশ বিস্তার বাধাগ্রস্ত হতে হতে একসময় বঙ্গোপসাগর মাছশুন্য হয়ে পড়বে। 


এসব বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে এনামুল হোসাইন অভিযোগ অস্বীকার করেণ। তিনি বলেন, জেলেরা নিজেদের মত মাছ শিকার করে বিক্রি করে। এতে আমার কোনো হাত নেই। যারা আমার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ করছে তারা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ। আমি ব্যবসা বানিজ্য করে টাকা পয়সা রোজগার করি। আমার অবৈধ কোনো আয়ের উৎস্য নেই। কেউ যদি প্রমান করতে পারে আমি জেলেদের দিয়ে মাছ শিকার করাই তবে আমি যে শাস্তি হয় মাথা পেতে নিতে রাজি। আর এতে আমার বড় ভাই নাজমুল হোসাইনের কোনো হাত নেই। তিনি তার মত চাকরি করেন আমি আমার মত ব্যবসা করি। আমি ব্যবসা করে ভালো আছি এটা অনেকের সহ্য হয়না বলেই ইর্ষান্বিত হয়ে এসব অপবাদ দিচ্ছে।


এনামুল হোসাইনের বড় ভাই শ্যমলী জোনের এডিসি নাজমুল হোসাইনের মুঠোফানে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি। বরগুনা-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য শওকত হাচানুর রহমান রিমনও ফোন ধরেননি। পাথরঘাটা উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা জয়ন্ত কুমার অপু বলেন, আমাদের লোকবল ও লজিস্টিক সাপোর্টের কারণে বিশাল এই অঞ্চলের অবৈধ মাছ শিকার বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। তবে নিয়মিত অভিযানে অনেক জাল জব্দ হয়েছে, চরঘেরা ও বেহুন্দির খুটি অপসারণ ও করেছি। কিন্ত বনের নিকটে হওয়ায় বন থেকে গাছ কেটে আবারো খুঁটি পুঁেত মাছ শিকার করছে অসাধু জেলে চক্র। 


উৎকোচের বিনিময়ে ম্যানেজের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন মৎস্য বিভাগের এই কর্মকর্তা। এ বিষয়ে জানতে বরগুনা বিভাগের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মতিয়ার রহমানের মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি। 


বরগুনার জেলা প্রশাসক মোহা. রফিকুল ইসলাম বলেন, কোস্টগার্ড, নৌ পুলিশ, বন বিভাগ , মৎস্য বিভাগ ও জেলা প্রশাসনে সমন্বয়ে আমরা শিঘ্রই ওই এলাকায় অভিযান পরিচালনা করব। কোনোভাবেই মাছের ক্ষতি করতে দেয়া হবেনা। যে বার যার নিয়ন্ত্রনেই হোক প্রমান পেলে আমরা আইনগত ব্যবস্থা গ্রহন করব। 



What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow