ফিলিস্তিনের গাজায় বিরামহীন হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল হাজারো মানুষ নিহত
ফিলিস্তিনের গাজায় বিরামহীন হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল। তাদের হামলায় হাজারো মানুষ নিহত হয়েছেন। যারা বেঁচে আছেন তারা ঘরবাড়ি হারিয়ে চরম খাদ্য সংকটে অভুক্ত দিন পার করছেন।
এ অভুক্তদের যেসব সংস্থা খাদ্যসহায়তা দিচ্ছে এবার তারাও প্রবল আক্রমণের শিকার হচ্ছে। এতে দাতব্য কাজ থেকে সরে আসতে বাধ্য হওয়ার ঘটনা ঘটছে। অবস্থা এমন যে, স্বাধীনতাকামীদের অস্ত্রের লড়াই পরিণত হচ্ছে কেবল ‘ক্ষুধার লড়াইয়ে’।
আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংগঠন আগে থেকে অভিযোগ করছে, ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ত্রাণসহায়তা প্রবেশে পরিকল্পিতভাবে বাধা দিয়ে আসছে ইসরায়েল। তার চাক্ষুস প্রমাণ পাওয়া গেল সোমবারের হামলায়। অভুক্ত মানুষদের মুখে একটু খাবার তুলে দিতে ‘ওয়ার্ল্ড সেন্ট্রাল কিচেন’ সমুদ্রপথে ত্রাণসহায়তা নিয়ে গাজায় পৌঁছায়। কিন্তু তারাও ইসরায়েলের বর্বরতার শিকার হয়ে খাদ্যসামগ্রী না দিয়েই ফিরে গেছে।ওয়ার্ল্ড সেন্ট্রাল কিচেনের মতো গাজায় কাজ করা অনেকে ভীত হয়ে পড়েছেন। আরও অনেকে ত্রাণ কার্যক্রম নিয়ে দ্বিতীয়বার ভাবতে পারে। নিজেদের জীবন বিপন্ন হওয়ার শঙ্কা দেখা দেওয়ায় স্বেচ্ছাসেবীরা স্বভাবতই হতাশ হয়ে পড়বেন।
এসব কারণে সেখানে ভয়াবহ মানবিক পরিস্থিতি আরও তীব্র হতে পারে। অবস্থা এমন যে, ফিলিস্তিনিরা আসলে কীসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে? ইসরায়েল সুকৌশলে অস্ত্রধারী ফিলিস্তিনিদের যুদ্ধ বদলে দিচ্ছে। এমনিতেই পরিস্থিতি এতই ভয়াবহ, গাজার মোট জনসংখ্যার অন্তত এক-চতুর্থাংশ অর্থাৎ প্রায় ছয় লাখ মানুষ দুর্ভিক্ষ থেকে এক ধাপ দূরে রয়েছেন। ইতিমধ্যে ২৮ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘের কর্মকর্তাদের বরাতে এসব তথ্য জানিয়েছে আলজাজিরা। রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, ওয়ার্ল্ড সেন্ট্রাল কিচেনের সাত ত্রাণকর্মী নিহত হওয়ার পর ত্রাণসামগ্রী খালাস বন্ধ করে দেয় সংস্থাটি। এরপর আর তা চালু করা হয়নি। অবশিষ্ট মালামাল নিয়েই সাইপ্রাসে ফিরে যাচ্ছে জাহাজটি। গত মঙ্গলবার সাইপ্রাসের কর্মকর্তারা বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
এর আগে জাহাজ থেকে ১০০ টন খাদ্য খালাস করেছিলেন কর্মীরা। সেসব দেইর আল বালাহ গুদামে রেখে ওই কর্মীরা স্থান ত্যাগ করছিলেন। ঠিক সে সময়ই তাদের গাড়ি লক্ষ্য করে গত সোমবার এ হামলা হয়। জাহাজটিতে ২৪০ টন খাবার ছিল। শরণার্থীদের মধ্যে খাবার বিতরণের দায়িত্বে থাকাদের উদ্দেশ্য করেই এ হামলা করা হয় বলে বিশ্ব অনেকটা নিশ্চিত। কারণ, ওই কর্মীদের বহনকারী দুটি গাড়ির একটিতে সংস্থাটির লোগো ছিল। এ ছাড়া সংস্থাটি ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে ত্রাণ কার্যক্রম চালাচ্ছিল। ওয়ার্ল্ড সেন্ট্রাল কিচেন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক দাতব্য সংস্থা। এর প্রধান অর্থদাতা ছিল সংযুক্ত আরব আমিরাত।
নিহতরা ফিলিস্তিন, অস্ট্রেলিয়া, পোল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, কানাডার নাগরিক। তাদের মধ্যে দ্বৈত নাগরিকও রয়েছেন। সংস্থাটির প্রধান নির্বাহী এরিন গোর বলেন, এটি শুধু ওয়ার্ল্ড সেন্ট্রাল কিচেনের ওপর হামলা নয়, এটি মানবিক সাহায্যকারী সংস্থার ওপর হামলা। খাদ্যকে যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে, এ আক্রমণ তাই নির্দেশ করে। এ ঘটনা ক্ষমার অযোগ্য। সাইপ্রাসের প্রেসিডেন্ট নিকোস ক্রিস্টোডৌলিডেস বলেন, ঘটনাটি দুঃখজনক। কিন্তু তা যেন গাজায় ত্রাণ পৌঁছাতে আমাদের নিরুৎসাহিত না করে। এ প্রচেষ্টা আমাদের দ্বিগুণ করতে হবে। বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা থেকে বিবৃতিতে হামলার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। এদিকে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী বলছে, এটি একটি মর্মান্তিক ঘটনা। পরিস্থিতি বোঝার জন্য সর্বোচ্চ স্তর থেকে একটি পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনা চলছে। একটি স্বাধীন, পেশাদার ও বিশেষজ্ঞদের দ্বারা ঘটনার তদন্ত করা হবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এ ধরনের বক্তব্য বাহিনীটি সব সময়ই দিয়ে থাকে। কার্যত কোনো পদক্ষেপ কখনোই চোখে পড়ে না। আলজাজিরা জানায়, গত বছরের ৭ অক্টোবর ইসরায়েল গাজায় সর্বাত্মক হামলা শুরু করে। এরপর থেকে ৩২ হাজার ৮৪৫ ফিলিস্তিনি নিহত হন। আহত হয়েছেন ৭৫ হাজার ৩৯২ জন। যারা বেঁচে আছেন তারা খাদ্য সংকটে অস্থির। জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা সংস্থার (ওসিএইচএ) উপপ্রধান রমেশ রাজাসিংহাম বলেছিলেন, ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের দিকে এসে গাজায় অন্তত ৫ লাখ ৭৬ হাজার মানুষ দুর্ভিক্ষ থেকে এক ধাপ দূরে অবস্থান করছেন। সে সময় গাজায় খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে বৈঠক করে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ। সেখানে রমেশ আরও বলেন, উত্তর গাজায় দুই বছরের কম বয়সী ছয়জনের মধ্যে একজন শিশু তীব্র অপুষ্টিতে ভুগছে। কার্যত ফিলিস্তিনি এই উপত্যকার ২৩ লাখ মানুষ দুঃখজনকভাবে অপর্যাপ্ত খাদ্য সহায়তার ওপর নির্ভর করে বেঁচে আছেন।
তিনি বলেন, যদি কিছু করা না হয় তাহলে আমরা আশঙ্কা করি গাজায় ব্যাপক দুর্ভিক্ষ প্রায় অনিবার্য। সংঘাতে আরও অনেক মানুষ হতাহত হবে। অন্যদিকে জেনেভায় ওসিএইচএর আরেক মুখপাত্র জেনস লায়েরকে সাংবাদিকদের বলেছেন, ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডের কারণে গাজায় ত্রাণসহায়তা সরবরাহ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, ত্রাণবাহী গাড়িবহর হামলার শিকার হচ্ছে। ইসরায়েলি সেনারা পরিকল্পিতভাবে যাদের ত্রাণসহায়তা প্রয়োজন তাদের কাছে সেগুলো পাঠাতে বাধা দিচ্ছে। মানবিক কর্মীদের হয়রানি, ভয়-ভীতি ও আটক করছে ইসরায়েলি বাহিনী। সর্বশেষ যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থাটির গাড়িতে হামলায় সংযুক্ত আরব আমিরাতের মন্তব্য ছিল, এ ধরনের হামলা মানবিক সহায়তা প্রচেষ্টাকে থামিয়ে দিচ্ছে। তারা ত্রাণকর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবি করেছেন। তা না হলে ফিলিস্তিন তথা গাজাবাসীর সামনে ভয়াবহ দুর্দিন যে অপেক্ষা করছে তা অনুমেয়।
What's Your Reaction?