মারধরের পর নদীতে ফেলে দেয়া হয় জেলে রিপনের মরদেহ
নিখোঁজের ২২ ঘন্টা পর বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার কালমেঘা ইউনিয়নের বিষখালী নদীর পূর্ব কালমেঘা পয়েন্ট থেকে জেলে রিপনের (৪৫) মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। শুক্রবার দিবাগত রাত একটার দিকে স্থানীয় জেলেদের সহায়তায় ওই জেলের মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজন জেলে ও নিহতের পরিবারের দাবি, মৎস্য বিভাগের অভিযানে আটক জেলে রিপনকে বেধরক মারপিটে নৌকায়ই নিহত হন জেলে রিপন। পরে তার মরদেহ নদীতে ফেলে দেয় অভিযানে অংশ নেয়া মৎস্য বিভাগের দুই শ্রমিক। এ ঘটনায় বরগুনা সদর উপজেলা মৎস্য এসএম মাহমুদুল হাসান ও তার সাথে থাকা শ্রমিকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন স্থানীয় জেলেরা।
নিহত রিপন কালমেঘা ইউনিয়নের দক্ষিণ কুপদোন গ্রামের রাজ্জাক হাওলাদারের ছেলে। তিনি পেশায় একজন ভ্যান শ্রমিক ছিলেন। তবে নদীতীরের বাসিন্দা হওয়ার দিনে ভ্যান চালানোর পাশাশি রাতে মাছ শিকারে যেতেন। মা, বাবা, স্ত্রী ও দুই সন্তানসহ ছয় সদস্য’র পরিবারে রিপন একাই ছিলেন উপার্জনক্ষম ব্যক্তি।
নিহতের স্ত্রী পাখি বেগম জানান, বৃহষ্পতিবার রাত ১২টার দিকে রিপন মাছ ধরার জন্য বাড়ি থেকে বের হয়ে কালমেঘা টুলু পয়েন্টে যান। স্থানীয় জেলে মাসুম বিল্লাহ জানান, রাত ২টার দিকে দুটি নৌকায় মোট চারজন জেলে নদীতে জাল ফেলতে যায়। এর মধ্যে জেলে রিপন ও নৌকার মালিক দেলোয়ার একটি নৌকায় ও জেলে রাসেল ও ইসা সালাম নামের এক জেলের নৌকায় জাল ফেলে নদীতে অপেক্ষা করছিল।
ঘটনায় আহত জেলে রাসেল জানান, রাত আড়াইটার দিকে বরগুনা সদর উপজেলা মৎস্য এসএম মাহমুদুল হাসানের নেতৃত্বে ছয়জন শ্রমিকসহ একটি স্পিডবোট সেখানে এসে ধাওয়া করে রাসেল ও ইসার নৌকাটি আটক করে। পরে রাসেলকে স্পিডবোটে তুলে নেন আর এসময় সুযোগ বুঝে ইসা সেখান থেকে নৌকাটি নিয়ে দ্রæত তীরে চলে আসেন। এরপর রাসেলসহ স্পিডবোটটি ধাওয়া দিয়ে দেলোয়ার ও রিপনকে নৌকাসহ আটক করে। এক পর্যায়ে দেলোয়ারকে স্পিডবোটে তুলে নিয়ে জেলে রিপনের নৌকায় দুজন শ্রমিককে রেখে জাল উঠানোর নির্দেশ দিয়ে জেলে রাসেল ও দেলোয়ারসহ স্পিডবোট নদীর পুবদিকে অভিযানে চলে যান মৎস্য কর্মকর্তা মাহমুদুল। রাসেল জানান, সেখানে গিয়ে কিছু নৌকা ও জেলেদের আটক করে বেধরক মারপিট করে জাল উঠিয়ে নিয়ে ফের স্পিডবোট চালিয়ে রিপনের বোটের কাছে আসেন ওই মৎস্য কর্মকর্তা। বোটে রিপনসহ মৎস্য কর্মকর্তার সাথে নিয়ে আসা দুজন শ্রমিককে রেখে গেলেও রিপনকে দেখতে না পেয়ে শ্রমিকদের কাছে রিপনের খোঁজ জানতে চান তিনি। এসময় ওই শ্রমিকরা জানান, রিপন নদীতে ঝাঁপ দিয়েছে। সকাল পর্যন্ত স্পিডবোট ও নৌকা নিয়ে তারা রিপনকে খুঁজতে থাকেন। খোঁজ না পেয়ে সকাল সাড়ে আটটারর দিকে আটক জেলে দেলোয়ার ও রাসেলকে কালমেঘা টুলু পয়েন্টে বোটসহ রেখে দিয়ে মৎস্য কর্মকর্তা স্পিডবোট নিয়ে বরগুনা চলে যান। পওে স্থানীয় জেলেরা আহতাবস্থায় রাসেল ও দেলোয়ারকে উদ্ধার করে পাথরঘাটা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ভর্তি করান। এ ঘটনায় আহত জেলে দেলোয়ার বলেন, আমাদের স্পিডবোটে তুলে বেধরক লাঠিপেটা করে মৎস্য কর্মকর্তার সাথে আসা কয়েকজন শ্রমিক। এতে আমরা উভয়ে আহত হয়ে বোটে পড়ে থাকি। রিপনকে যে শ্রমিকদের কাছে নৌকায় রেখে যাওয়া হয়েছিল ওই শ্রমিকরা বেধরক লাঠিপেটা করেছে। আমার ধারণা এতেই রিপনের মৃত্যু হয় এক পর্যায়ে তাকে নদীতে ফেলে দেয়া হয়।
দক্ষিণ কুপদোন এলাকার এক জেলের নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমার ও নৌকা জাল আছে। মৎস্য বিভাগের অভিযানের খবর পেয়ে আমি খোঁজ নিতে রাত আড়াইটার পরে নদীতীরে গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে মাঝ নদীতে চিৎকারের শব্দ পেয়ে টর্চ লাইটের আলো ফেলি। এসময় নৌকা থেকে আমাকে লাইট না মারতে সঙ্কেত দেয়া হয়। আমি শুনতে পাই, স্যার আমারে আর মাইরেন না, এই জাল এখন উঠানো সম্ভব না। সম্ভব হলে আমি উঠায়ে দিতাম। পাও ধরছি স্যার, আমারে আর মারলে মইরা যামু।’ ওই জেলে বলেন, কিছুক্ষণ পর আর সাড়া শব্দ না পেয়ে আমি বাড়িতে চলে আসি। পরেরদিন জানতে পারি জেলে রিপন নিখোঁজ।
কালমেঘা টুলু পয়েন্ট এলাকার জেলে মাসুম বিল্লাহ বলেন, অবৈধ জাল উদ্ধারে গভীর রাতে মৎস্য বিভাগের কর্মকর্তারা কিছু শ্রমিক সাথে নিয়ে আসেন। এই শ্রমিকরা জেলেদের ব্যপক মারধর করে। বিভিন্ন সময়ে এরা অভিযানে নেমে অনেক জেলেকে মেরে আহত করেছে। ওইদিন আমাদের এপাড়ের জেলে দেলোয়ার ও রাসেলকে মেরে আহত করে রেখে গেছে। আর রিপনকে তারা পিটিয়ে হত্যা করে নদীতে ফেলে দিয়েছে। এমনকি রিপন নিখোঁজ হওয়ার পর মৎস্য বিভাগের কোনো কর্মকর্তা উদ্ধারেও সহযোগীতা করেনি। আমরা শুক্রবার দিনভর নিজেরা খুঁজেছি। অবশেষে রাত ১টার দিকে পুর্ব কালমেঘা এলাকায় নদীতে ভাসমান অবস্থায় রিপনের মরদেহ খুঁজে পেয়ে পুলিশকে খবর দেই। মাসুম বলেন, আমার ভাইকে মৎস্য কর্মকর্তার নির্দেশে মারধর করা হয়েছে আর এতে তিনি নিহত হয়েছেন। আমরা এক দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।
পাথরঘাটা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোস্তফা গোলাম কবির বলেন, মরদেহ উদ্ধারের সময় আমি উপস্থিত ছিলাম। রিপনের নাকে মুখে রক্ত ও পিঠে আঘাতের চিহ্ন দেখেছি। তাকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। মৎস্য বিভাগ অভিযানে নেমে জেলেদের মারধর করে এমন অভিযোগ আগেও আমি জেলেদের কাছ থেকে শুনেছি। তারা আইন হাতে তুলে নেয়ার অধিকার রাখেনা। আমরা রিপন হত্যার বিচার চাই।
এ বিষয়ে কথা বলতে বরগুনা সদর উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা এসএম মাহমুদুল হাসান বলেন, আমরা অভিযানে গিয়েছিলাম এবং রাসেল ও দেলোয়ার নামের দুজন জেলেকে নৌকাসহ আটক করেছিলাম। অভিযান শেষে তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। সেখানে রিপন নামের কাউকে আটক করা হয়নি। রিপনকে মারধর কওে নদীতে ফেলে হত্যার বিষয়টি অস্বীকার করে তিনি বলেন, জেলেদের অবৈধ জাল ফেলে মাছ শিকারে বাঁধা দেয়ায় আমাদে বিরুদ্ধে জেলেরা রিপনকে নিয়ে ষড়যন্ত্র করছে।
পাথরঘাটা থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি তদন্ত) মোঃ সাইফুজ্জামান বলেন, খবর পেয়ে ঘটনাস্থল থেকে মরদেহটি উদ্ধার করে সুরতহাল শেষে ময়না তদন্তে পাঠানো হয়েছে। এখনো আমরা কোনো অভিযোগ পাইনি। অভিযোগ পাওয়ার পর তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
উল্লেখ্যঃ গত বৃহস্পতিবার রাত আড়াইটার দিকে বিষখালী নদীতে বরগুনা সদর মৎস্য বিভাগের অভিযানে মারধরে ঘটনা ঘটে। এসময় নদীতে পরে পাথরঘাটা উপজেলার কালমেঘা ইউনিয়নের জেলে রিপন নিখোঁজ হয়। নিখোঁজের ২২ ঘন্টা পর শুক্রবার দিবাগত রাত বারোটার দিকে কালমেঘার ছোনবুনিয়ার একটি জঙ্গল থেকে ভাসমান অবস্থায় উদ্ধার করে স্থানীয় জেলে ও স্বজনরা।
What's Your Reaction?