ব্যভিচার ও পরোকিয়া বাংলাদেশের প্রচলিত আইন
পরকীয়া হলো বিবাহিত ব্যক্তির বিবাহের বাইরের রোমান্টিক সম্পর্ক, যা যৌন সম্পর্ক স্থাপনের আগেও হতে পারে। অন্যদিকে, ব্যভিচার হলো পরকীয়ার এমন একটি রূপ, যেখানে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করা হয়।
আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে পরকীয়া
বাংলাদেশে পরকীয়া
বাংলাদেশের আইনে পরকীয়ার সংজ্ঞা এবং এর সাথে সম্পর্কিত আইনি দিকগুলি ব্যভিচার (adultery) ধারা অনুযায়ী নির্ধারিত হয়েছে।
ব্যভিচার ও পরকীয়ার মধ্যে পার্থক্য
পরকীয়া হলো বিবাহিত ব্যক্তির বিবাহের বাইরের রোমান্টিক সম্পর্ক, যা যৌন সম্পর্ক স্থাপনের আগেও হতে পারে। অন্যদিকে, ব্যভিচার হলো পরকীয়ার এমন একটি রূপ, যেখানে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করা হয়।
দণ্ডবিধি ৪৯৭ ধারা
বাংলাদেশে ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির ৪৯৭ ধারা অনুযায়ী ব্যভিচার একটি অপরাধ, তবে পরকীয়া সরাসরি অপরাধ হিসাবে গণ্য নয় যদি না তা যৌন সম্পর্ক স্থাপনে পরিণত হয়।
দণ্ডবিধির ৪৯৭ ধারায় ব্যভিচার:
"যদি কোন ব্যক্তি অন্য ব্যক্তির স্ত্রী বা যাকে সে অপর কোন লোকের স্ত্রী হিসেবে জানে বা অনুরূপ বিশ্বাস করার কারণ রয়েছে এমন কোন ব্যক্তির স্ত্রীর সাথে উক্ত স্ত্রীর স্বামীর সম্মতি বা সমর্থন ব্যতিরেকে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করে যা নারী ধর্ষণের সামিল নয়, তাহলে সেই ব্যক্তি ব্যভিচারের অপরাধে দোষী এবং যেকোনো মেয়াদের কারাদণ্ড (যাহার মেয়াদ পাঁচ বছরের অধিক নয়) বা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারে। তবে, অনুরূপ ক্ষেত্রে স্ত্রীলোকটি উক্ত দুষ্কর্মের সহায়তাকারী হিসাবে দণ্ডনীয় হবে না।"
ব্যভিচার: ধর্মীয় বিধান, সংবিধান ও প্রচলিত শাস্তি
ধর্মীয় বিধান
ইসলামী আইন: ইসলামে ব্যভিচার (যিনা) একটি গুরুতর অপরাধ। ইসলামী শাস্ত্র অনুযায়ী ব্যভিচারের শাস্তি অত্যন্ত কঠোর। প্রমাণিত হলে শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড (প্রস্তরাঘাতে মৃত্যু) বা বেত্রাঘাতের বিধান রয়েছে। তবে, এই শাস্তি প্রয়োগের জন্য প্রমাণের ক্ষেত্রে চারজন প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য প্রয়োজন।
হিন্দু ধর্ম: হিন্দু ধর্মে ব্যভিচার একটি গুরুতর পাপ হিসাবে বিবেচিত। মনুস্মৃতিতে ব্যভিচারীর জন্য কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে। প্রাচীন হিন্দু আইনে ব্যভিচারের জন্য কঠোর শাস্তি দেওয়া হতো।
খ্রিস্টান ধর্ম: খ্রিস্টান ধর্মেও ব্যভিচারকে গুরুতর পাপ হিসেবে গণ্য করা হয়। বাইবেলে ব্যভিচারের শাস্তি সম্পর্কে উল্লেখ রয়েছে, তবে আধুনিক খ্রিস্টান সমাজে এটি সাধারণত সামাজিক এবং নৈতিক অবক্ষয়ের দিকে ইঙ্গিত করে।
সংবিধান
বাংলাদেশের সংবিধানে সব নাগরিকের সমান অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। সংবিধানের বিভিন্ন অনুচ্ছেদে আইনগত দৃষ্টিতে সকল নাগরিকের সমান অধিকার ও সুযোগের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে।
- অনুচ্ছেদ ২৬: সংবিধানের সহিত সকল প্রচলিত আইন যতখানি অসামঞ্জস্য ততখানি বাতিল হইবে এবং রাষ্ট্র অসামঞ্জস্যপূর্ণ কোন আইন প্রণয়ন করবে না।
- অনুচ্ছেদ ২৭: আইনের দৃষ্টিতে রাষ্ট্রের সকল নাগরিক সমান এবং আইনের আশ্রয় লাভের ক্ষেত্রে সমান অধিকার সুনিশ্চিত করা হয়েছে।
- অনুচ্ছেদ ২৮: ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারীপুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে রাষ্ট্র কোন নাগরিকের প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করবে না এবং রাষ্ট্র-গণজীবনের সর্বস্তরে নারীপুরুষের সমান অধিকারের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে।
- অনুচ্ছেদ ৩১: আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার দেওয়া হয়েছে।
ভারতের সুপ্রিম কোর্টের রায়
ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ২০১৮ সালে একটি রায়ে ৪৯৭ ধারা অসাংবিধানিক ঘোষণা করেছে এবং ব্যভিচারকে ফৌজদারি অপরাধ থেকে বাদ দিয়েছে। এটি ব্যক্তিগত এবং নৈতিক বিষয় বলে উল্লেখ করেছে। বাংলাদেশের আইনও সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হতে পারে, তবে এখন পর্যন্ত ব্যভিচার একটি অপরাধ হিসেবেই গণ্য হয়।
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট
অনেক দেশেই পরকীয়া এখন আর অপরাধ হিসাবে গণ্য হয় না। পশ্চিমা দেশগুলিতে এটি সাধারণত নৈতিক ও ব্যক্তিগত সমস্যার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। তবে, মধ্যপ্রাচ্য এবং অন্যান্য কিছু রক্ষণশীল সমাজে এটি এখনও কঠোরভাবে শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
বাংলাদেশের দণ্ডবিধির ৪৯৭ ধারায় শুধুমাত্র ব্যভিচারী পুরুষকে সাজা দেওয়া হয় এবং ব্যভিচারীনি স্ত্রীলোককে সাজা থেকে দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে। এই বিষয়গুলি নিয়ে কিছু আইনগত এবং ঐতিহাসিক প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। নিম্নলিখিত ব্যাখ্যাগুলি সেই প্রশ্নগুলির উত্তর দেয়ার চেষ্টা করবে:
১. কেন শুধুমাত্র ব্যভিচারী পুরুষকে সাজা দেওয়া হয়?
১৮৬০ সালের দণ্ডবিধি যখন প্রণীত হয়, তখনকার সামাজিক এবং নৈতিক মানদণ্ডের প্রতিফলন হিসেবে এ ধারা প্রণীত হয়েছিল। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে নারীদের উপর পুরুষের প্রভাব এবং নিয়ন্ত্রণকে একটি সামাজিক নিয়ম হিসাবে দেখা হত। সেই প্রেক্ষাপটে আইনের মাধ্যমে পুরুষকেই প্রধানত দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল, কারণ নারীদেরকে সমাজে প্রায়শই নিষ্ক্রিয় ভুক্তভোগী হিসাবে দেখা হত। এটি ছিল একধরনের পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতার প্রতিফলন।
২. আইনের মাধ্যমে কেন ব্যভিচারীনি স্ত্রীলোককে সাজা থেকে দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে?
এই ধারা প্রণয়নের সময়, নারীদের সামাজিক অবস্থান ছিল সীমিত এবং তারা সাধারণত পরিবারে নির্ভরশীল ছিলেন। আইন প্রণেতারা ধরে নিতেন যে, নারীরা নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে এমন পরিস্থিতিতে জড়িয়ে পড়তে পারে এবং সেই কারণে তাদেরকে দায়মুক্তি দেওয়া হয়। তাছাড়া, ঐ সময়ে নারীদেরকে সামাজিকভাবে পুরুষের চেয়ে দুর্বল এবং নির্ভরশীল হিসাবে বিবেচনা করা হত।
৩. কেন ব্যভিচারীনি স্ত্রীলোকের স্বামীর সম্মতির কথা বলা হয়েছে?
আইনটি প্রণয়নের সময় বিবাহকে একটি চুক্তি হিসেবে দেখা হতো, যেখানে স্বামীর সম্মতি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। যদি স্বামী পরকীয়ার সম্মতি দেন, তাহলে এটি আইনত অপরাধ হিসাবে গণ্য হত না, কারণ তখন এটি স্ত্রীর অবৈধ সম্পর্ক হিসাবে ধরা হত না। এই ধারণা পুরুষের নিয়ন্ত্রণের প্রতিফলন এবং বিবাহিত নারীদের অধিকার হ্রাসের ইঙ্গিত দেয়।
৪. কেন ব্যভিচারীনি স্ত্রীলোকের স্বামীকে মামলা করার অধিকার দেওয়া হয়েছে?
এই ধারাটি মূলত পুরুষের অধিকার এবং সম্মান রক্ষার উদ্দেশ্যে প্রণীত হয়েছিল। স্বামীর অধিকারকে কেন্দ্র করে এই আইন তৈরি হয়েছিল এবং এই কারণে স্বামীকে মামলা করার অধিকার দেওয়া হয়। এটি পুরুষের সম্পত্তির অধিকার এবং পারিবারিক সম্মান রক্ষার উদ্দেশ্যে করা হয়েছিল।
উপসংহার
পরকীয়া মূলত একটি নৈতিক এবং সামাজিক বিষয়। বাংলাদেশের আইনের দৃষ্টিতে পরকীয়া তখনই অপরাধ হিসাবে গণ্য হয়, যখন তা যৌন সম্পর্ক স্থাপনে পরিণত হয় এবং তখন তা ব্যভিচার হিসাবে বিবেচিত হয়। বর্তমান আইনের ৪৯৭ ধারার মাধ্যমে পরকীয়ার শাস্তির বিধান রয়েছে, তবে এটি শুধুমাত্র পুরুষের জন্য প্রযোজ্য এবং নারীদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তির বিধান নেই। সংবিধান অনুযায়ী সকল নাগরিকের সমান অধিকার নিশ্চিত করার জন্য, এ ধারা সংশোধন এবং সমসাময়িক প্রেক্ষাপটে মানানসই আইন প্রণয়ন জরুরি।
১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির ৪৯৭ ধারা যখন প্রণীত হয়েছিল, তখনকার সমাজ এবং সামাজিক মানদণ্ডের উপর ভিত্তি করে এই ধারা তৈরি হয়েছিল। বর্তমান সমাজের প্রেক্ষিতে এই ধারা পুরাতন এবং অনেকাংশে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। সমসাময়িক আইন ও মানবাধিকার চর্চার আলোকে এই ধারার সংস্কার প্রয়োজন, যাতে পুরুষ এবং নারীর প্রতি সমান আচরণ নিশ্চিত করা যায় এবং সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়।
What's Your Reaction?