শিক্ষার্থী কর্তৃক লাঞ্ছিত 'শিক্ষক'! জনপ্রিয়তা হারাবে ছাত্র জনতা?
গত ৫ আগষ্ট ছাত্র জনতার হাতে পরাজিত হয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায় স্বৈরাচার সরকার প্রধান শেখ হাসিনা। দেশ ত্যাগের পর আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির বেশ অবনতি ঘটে। এর অবশ্য কারণও রয়েছে বেশ। মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে শেখ হাসিনার অনুগতরা প্রশাসনের বড় বড় পদগুলো দখল করে রাখা। তার পালিয়ে যাওয়ায় ওই কর্মকর্তারা এক প্রকার কোনঠাসা হয়ে পরলে মাঠ পর্যায়ে দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা তাদের দায়িত্ব থেকে পিছিয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত অর্ন্তবর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নিয়ে প্রশাসনে বড় রদবদল করলেও মাঠে তেমন সক্রিয় নয় প্রশাসন। এটি স্বচ্ছ কাঁচের মতই পরিস্কার। এর কারণ জেলা পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের নানা ভূমিকাকে দায়ী করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোষ্টও করেছেন অনেকে। তার মধ্যে অন্যতম করে অনেকে উল্লেখ করছেন শিক্ষকদের সাথে অসৌজন্য মূলক আচরণ।
শিক্ষকদের সাথে অসৌজন্য মূলক আচরণের বেশ কিছু ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পরলে এটি নিয়ে অনেকে সমালোচনা করছেন। সারাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভিসিদের পদত্যাগ করানোর পরপরই জেলা পর্যায়ে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের জোর করে পদত্যাগ এই আলোচনার জন্ম দেয়। এ নিয়ে সমাজে চলছে নানা আলোচনা সমালোচনা।
দীর্ঘ ১৬ বছর একটা স্বৈর শাসন ব্যবস্থা চলছিল দেশে। এ সময় বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আওয়ামী পন্থীরা প্রতিষ্ঠান প্রধান হিসেবে নিয়োগও পেয়েছেন। প্রতিষ্ঠান চালিয়েছেন ইচ্ছেমত করে। অবশ্য তখন তো কোন উপায়ও ছিল না। কেউ কি কখনও কথা বলতে পেরেছে স্বৈর শাসকের বিরুদ্ধে?
ছাত্রজনতার আন্দোলনে বেশ ভূমিকা পালন করেছে সাধারন জনতা। কারণ আমরা বাঙালিরা পরাধীন থাকতে ইচ্ছুক নই। স্বৈর শাসক আমরা চাই না। সেজন্য ছাত্র জনতার সাথে এই আন্দোলনে সাধারণ জনতার ভূমিকা ছিল অপরিসীম।
বলা হচ্ছে দেশ দ্বিতীয়বার স্বাধীন হয়েছে। আমরা বাক স্বাধীনতা পেয়েছি। এখন মুক্তভাবে কথা বলতে পারি। আদৌ কি সেটা পারি বা পারব? এটা আমার প্রশ্ন থাকবে। একটা দেশের সরকারের সমালোচনা মুক্তভাবে করতে পারাটা স্বাধীনতার বড় অংশ। ছাত্রজনতা দেশ পরিচালনায় সহযোগিতা করছে বিধায়ই তাদের নিয়ে সমালোচনা করাটা যৌক্তিক বলে আমি মনে করি।
জেলাগুলোর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের জোর করে পদত্যাগ করানো হচ্ছে। এমন ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাসছে। এ নিয়ে সমালোচনাও চলছে বেশ। যেহেতু দেশে বর্তমানে ছাত্রজনতার রূপরেখায় একটি সরকার গঠিত হয়ে দেশ পরিচালিত হচ্ছে সেহেতু তাদের অন্যায়গুলো আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বিচার হওয়া উচিৎ। জোর করে পদত্যাগ এটা কি আইনের মধ্যে পরে? তাহলে তো প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, স্বৈরাচারী স্বভাবটা আমাদের মধ্যে রয়েছে বেশ।
সরকার যেহেতু ছাত্রজনতার রূপরেখায় গঠিত হয়েছে সেহেতু এই সরকারের উপর তাদের আস্থাও রয়েছে। সেখানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আন্দোলন করে প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ অথবা অন্যকোন শিক্ষককে জোর করে পদত্যাগ করানো আইনসম্মত হচ্ছে? সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা গত ২৫ আগষ্ট বলেছেন "শিক্ষায় পদত্যাগে বাধ্য করে অস্থিরতা সৃষ্টি করলে প্রশাসন ভেঙে পড়তে পারে"। অন্যদিকে ২৮ আগষ্ট জাতীয় ছাত্র পরিষদের প্রধান সমন্বয়ক এলাহান কবীর বলেন "ফ্যাসিবাদের পতন হওয়ার পর দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী ও প্রভাবশালীরা জোরপূর্বক শিক্ষকদের পদত্যাগ করাচ্ছেন। বিষয়টি খুবই উদ্বেগজনক ৷ আমরা এসব ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। দেশে আইন আদালত বিদ্যমান আছে। যদি কেউ অন্যায় করে থাকেন তাহলে আইন অনুযায়ী বিচার হবে। কিন্তু প্রভাব খাটিয়ে বেআইনিভাবে কাউকে পদত্যাগ করানো কোনো অবস্থাতেই কাম্য নয়।" এরপরও থামছে না শিক্ষার্থীদের অসৌজন্য মূলক আচরণ।
বরিশাল বিভাগের অন্যমত একটি মাদ্রাসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান 'ঝালকাঠি এন. এস. কামিল মাদ্রাসা' সেখানেও শিক্ষকের পদত্যাগ নিয়ে ছাত্রদের দুই গ্রুপের সংঘর্ষের মত ঘটনা ঘটেছে। সংঘর্ষে আহত হয়েছে ১১ জন। অথচ ২০২৪ সনের দাখিল পরীক্ষার ফলাফলে দেশের মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে এই প্রতিষ্ঠানটি। এই প্রতিষ্ঠানে এমন ঘটনা এই প্রথম। অন্যদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখা যায় বরগুনার অন্যতম আরেকটি মাদ্রাসা 'দারুল উলুম নেছারিয়া কামিল মাদ্রাসা' এর অধ্যক্ষের পদত্যাগের দাবীতে প্রতিষ্ঠানের মধ্যে গত ২৯ আগষ্ট আন্দোলন করে শিক্ষার্থীরা। প্রশাসনের পক্ষ থেকে বার বার তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস নেয়ার কথা বললেও মানতে চায় না শিক্ষার্থীরা। পরে বিকাল ৫টায় জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে বৈঠকে বসার আহবান করলে শান্ত হয় শিক্ষার্থীরা। পরে অধ্যক্ষকে একমাসের ছুটিতে পাঠানো হয় এবং অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। প্রতিষ্ঠানটির বেশ কয়েকজন শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের গোপনে উস্কানি দিচ্ছে। ওই আসনের সাংসদ ও জেলা আ'লীগের সভাপতি ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু সবশেষ ৩১ জুলাই ২০১৬ পর্যন্ত সভাপতি ছিলেন। তৎকালীন হাইকোর্টের একটি আদেশে এমপিরা সভাপতির দায়িত্ব ছাড়েন। সেই থেকে জেলা প্রশাসক সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। যেহেতু সভাপতিরা সরকারের এবং প্রশাসনের দায়িত্বশীল ব্যক্তি সেহেতু অধ্যক্ষের অনিয়মের দায়ভার তারা এড়াতে পারে না। তাহলে শাস্তি কেন শুধু শিক্ষকের হবে? এখানে আমি শুধুমাত্র দুটি প্রতিষ্ঠানের উদাহরণ দিয়েছি। নওগার একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান কে জোর করে পদত্যাগ পত্রে স্বাক্ষর করানোর সময় তাকে অসুস্থ হতে দেখেছি। এমনকি একটি প্রতিষ্ঠান প্রধান কে জোর করে পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করায় তিনি অঝোরে কেঁদেছেন এমন ভিডিও দেখেছি।
শিক্ষার্থীরা অনেক ক্ষেত্রে দাবী করছেন, শিক্ষকের দূর্ণীতি। সেই কারণে তার পদত্যাগ চান। এ প্রসঙ্গে আলোচনায় আসছে নিয়োগে আর্থিক লেনদেন। একটা এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানগণ চাইলেই কি সব করতে পারেন? অবশ্যই না। কারণ ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ম্যানেজিং কমিটির অনুমোদন ছাড়া অর্থ ছাড়করণ, বেতন বিল, নিয়োগ দেয়াসহ কোন কাজ করার ক্ষমতা প্রতিষ্ঠান প্রধানদের থাকে না। সেক্ষেত্রে সভাপতির উপর দায়িত্বটা বেশ শক্তপোক্ত। ম্যানেজিং কমিটি ভেঙে দেয়ায় সভাপতিরা যেন স্বস্তির নিশ্বাস নিচ্ছেন। এখন দায় পরেছে প্রতিষ্ঠান প্রধানদের ঘাড়ে।
এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিয়োগের ক্ষেত্রে ৫ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি থাকে। যেখানে প্রতিষ্ঠানের সভাপতি অথবা ম্যানেজিং কমিটির মধ্য থেকে তাদের মনোনিত একজন সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। সেখানে প্রতিষ্ঠান প্রধান থাকেন সদস্য সচিব। এছাড়াও ডিজির প্রতিনিধি ছাড়াও আরও দুইজন সদস্য থাকেন। প্রশ্ন হচ্ছে টাকা কি তাহলে প্রতিষ্ঠান প্রধান একাই ভোগ করেন? নিয়োগে অনিয়ম সংক্রান্ত বহুবার সংবাদ করতে গিয়ে যতটুকু অভিজ্ঞতা হয়েছে তাতে বলতে পারি 'কখনই না'। নিয়োগ কমিটি এবং ম্যানেজিং কমিটি সবাই মিলেই ভাগাভাগি করেন এমনটা পরিস্কার। এসব বিষয় লিখিত অভিযোগ দিলেও কর্তৃপক্ষ কোন ব্যবস্থা নেয়নি। যার বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছি বহুবার সংবাদকর্মী হিসেবে। সংবাদকর্মী হয়ে তথ্য তুলে ধরলেও যথাযথ ব্যবস্থা নেয়নি কর্তৃপক্ষ। যার কারণে এসব লাগামহীনভাবে চলেছে। যেহেতু স্বৈরাচার ক্ষমতায় বসাছিল সেহেতু যে বিচার করবে তার বিচার যেন তার কাছেই চেয়েছি এমনটা মনে হয়েছে।
"শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড" ভাব সম্প্রসারণ পড়ছি। তবে আজ স্বৈরাচার ক্ষমতায় থাকা এবং ক্ষমতা থেকে বিদায় নেয়া থেকে এখন পর্যন্ত এই ভাব সম্প্রসারণ নিয়ে সন্দিহান অবস্থান আমার। শিক্ষককে পিতা-মাতার সাথে তুলনা করা হয়। আমরা সেভাবেই শিক্ষকদের শ্রদ্ধা করি। তবে ১৬ বছর ধরে এক এক করে শিক্ষা ব্যবস্থা যেভাবে ধ্বংস হয়েছে তাতে শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে কেমন ব্যবহার পাবে সেটা আজ ষ্পষ্ট। এই অবস্থায় শিক্ষক সমাজ লজ্জিত বলেও অনেক শিক্ষক গোপনে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন।
আমরা এমন কথা অনেকেই শুনেছি একটা সময় ছিল, শিক্ষক যেই রাস্তা দিয়ে যেত শিক্ষার্থী সেখানে দাড়িয়ে পরত। এই কথা দ্বারা বোঝানো হতো শিক্ষকের মর্যাদা কতটুকু। কিন্তু আজকের এই দিনে এসে শিক্ষকরা যেই পরিস্থিতিতে দাড়িয়েছে তাতে শিক্ষক পেশা থেকে অনেকেই মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন।
বাস্তবতা থেকে আমার অভিজ্ঞতার কথা না বললেই নয়। অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সভাপতিকে অনৈতিক সুবিধা না দিলে তিনি বিল কাগজে স্বাক্ষর করতেন না। ফলে একপ্রকার বাধ্য হয়েই স্বৈরাচারী সরকারের তালে তাল মিলিয়ে গেছেন। কারণ সভাপতি তো স্বৈরাচার সরকারের দলের লোক। এমন করে নির্যাতিত হয়েও আজ স্বাধীন বাংলাদেশ ২.০ তে দাড়িয়ে প্রতিষ্ঠান প্রধানরা দায়ী। অনেক শিক্ষক বর্তমানে দাবী করেন পূর্বের ভুলত্রুটির জন্য তাদের একাকে কেন দায়ী করে শিক্ষার্থীরা জোর করে পদত্যাগ করাচ্ছে? জোর করে পদত্যাগ আইন সম্মত?
জোর করে পদত্যাগ নিয়ে শিক্ষকসমাজ এবং ছাত্রসমাজের মধ্যে বেশ দূরত্ব সৃষ্টি হচ্ছে। এ নিয়ে দু-এক লাইন অনেকেই লিখছেন। তাদের লেখায় পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে শিক্ষার্থীদের জোর করে শিক্ষকদের পদত্যাগ করানোর ঘটনা খুব দ্রুতই জনপ্রিয়তা হারাতে পারে ছাত্র সমাজ। এ অবস্থায় দ্রুত সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে বলে আমি মনে করি। যেহেতু প্রতিবিপ্লবের শঙ্কা এখনও কাটেনি সেহেতু এখনি এ বিষয় গুরুত্ব দেয়া খুব জরুরি বলে মনে করছি।
বিঃদ্রঃ লেখনি আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সমালোচনা এবং শিক্ষকদের আলোচনায় উঠে আসা মতামত থেকে লেখা হয়েছে।
লেখকঃ মোঃ সানাউল্লাহ, গণমাধ্যমকর্মী।
What's Your Reaction?